Sunday 18 October 2015

সুহৃদ প্রামাণ্য চিত্র : ’অন্তিম শয়নে আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী’ (ভিডিও সহ)



                                 
                                     
মেরীল্যান্ডে আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি: রোজারিও’র নিকট  ’অন্তিম শয়নে আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী’  সুহৃদ প্রামাণ্য চিত্রটি হস্তান্তর করেন  সুহৃদ  সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডা: নেভেল ডি: রোজারিও ও আর এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এলবার্ট গমেজ।                            


















- ডা: নেভেল ডি: রোজারিও
             

আজ থেকে ৩৮ বছর আগে আকস্মিক হৃদ-ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ খ্রীষ্টমন্ডলীর প্রাণপুরূষ আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী সিএসসি। প্রথম বাঙ্গালী আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী সিএসসিকে মৃর্ত্যুর ২৯ বছর পর পূণ্য পিতা পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তাঁকে 'ঈশ্বরের সেবক' হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রয়াত আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী জাতি, সম্প্রদায়  ও মন্ডলীর সবার প্রগতি ও মঙ্গল কামনায় জীবনভর সাধনা করে গেছেন । তাঁর সাধনার ফল্গুধারায় আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মান্ডলিক জীবন আজ ফলে ফুলে বিকশিত। 

রমনা গির্জায় অনুষ্ঠিত তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হিন্দু , মুসলমান, বেীদ্ধ, খ্রীষ্টান ধর্মনির্বিশেষে শোকে মুহ্যমান লাখো মানুষের নেমেছিল ঢল। ইতিহাসের পাতায় যে সব বিরল ব্যক্তিত্ব তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টায় বাংলাদেশের খ্রীষ্টভক্ত এবং জনগণের কাছে অমর হয়ে আছেন যুগ থেকে যুগান্তরে--- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী সিএসসি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে কুখ্যাত মোনেম খানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ময়মনসিংহের খ্রীষ্টান জনগোষ্ঠীকে ভারতে ঠেলে পাঠানোর প্রতিবাদ করার কারণে স্বল্প সময়ের নোটিশে আর্চবিশপ গ্রেণার সিএসসি কে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিস্কার করার পরে এক রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় ঢাকার তখনকার সহকারী বিশপ টি,এ,গাঙ্গুলী ১৯৬৭ সনের নভেম্বর ২৩,ঢাকা মজা-ধর্মপ্রদেশের(আর্চ-ডায়োসিসের) আর্চবিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

সুহৃদ সংঘ নিছক একটা ক্লাব, সংঘ বা সমিতি বলতে যা বুঝায় আদতে তা ছিল না বরং এ ছিল একটি আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিল শেকড়ের অন্বেষণের পাশাপাশি খ্রীষ্টান সমাজে প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত অন্যায় অবিচারের বিরূদ্ধে স্বোচ্চার প্রতিবাদী কন্ঠ এবং সমাজে বহমান বিপরীতমুখী স্রোতধারার বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়ে তা পাল্টানোর একটি সমবেত সাহসী পদক্ষেপ। আর এ পদক্ষেপের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে সংঘ গ্রহণ করেছিল কিছু ব্যতিক্রমধর্মী সাংস্কৃতিক কর্মসূচী ---- এগুলোতে যখনই কোন বাধা আসতো তা উত্তরণে সব সময়ই ইতিবাচক ভূমিকা ছিল আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর। আর্চবিশপ গাঙ্গুলী বিশ্বাস করতেন যে সাধারণ মানুষের সক্ষমতা এবং মানবিক অর্জন গুলো সাংস্কৃতিক ভাবনায় যুক্ত করতে হবে। আমাদের সম্প্রদায়ে প্রচলিত প্রাচীন বদ্ধমুল চিšতা-চেতনা, শিক্ষা, প্রবৃত্তি দিয়ে এ পরিবর্তনশীল বিশ্বকে বোঝা যে কোনোভাবেই সহজ কাজ নয়, তা ঠিকই তিনি অনুভব করেছিলেন। আর এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বলেই সবাইকে সংস্কৃতিমনা  হতে উৎসাহিত করতেন সব সময়। তাইতো সুহৃদ বাহিনী সেদিন প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিয়ে সদলবলে উপস্থিত হ’ল কাকরাইলস্থ আর্চবিশপ হাউজ প্রাঙ্গঁণে। আমি তখন ঢাকা মেডিকেলে ইর্ন্টানী করছি। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম আর্চবিশপ হাউজে। ফাঃ বেঞ্জামিন কস্তা, ফাঃ জ্যোতি গমেজ সহ অনেকের  সাথে আলাপ  শেষে তাঁরা মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবন্থা করতে বললেন। তখনকার দিনে আজকের মত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৃতদেহ সংরক্ষণের কোন ব্যবন্থা ছিল না। তখনকার দিনের ব্যবস্থামত ঢাকা  মেডিকেল  কলেজের  ফরেনসিক মেডিসিন (পোষ্ট মোর্টেম) বিভাগের রবি ডোমকে এনে রগের ভেতর সিরিঞ্চ দিয়ে সুঠামদেহী মাঝারি আকারের হালকা পাতলা গড়নের আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর মৃতদেহে ফরমালিন প্রবেশ করানো হলো। আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর মৃতদেহ প্রার্থনারত ধর্মব্রতধারী-ধারিনী সিষ্টার, ফাদার. ব্রাদার, সেমিনারীয়ান ও সাধারণ খ্রীষ্টভক্ত পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় রমনা ক্যাথিড্রাল গীর্জার ভেতরে রাখা ছিল। সুহৃদ গানের দল অন্যান্যের সাথে প্রার্থনার মাঝে মাঝে ধর্মীয় গান পরিবেশন করলো।

         মূল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ও সহার্পিত খ্রীষ্টযাগে বাংলাদেশের তিন বিশপসহ অংশ নেন শতাধিক পুরোহিত। সুহৃদ গানের দল বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক সুহৃদ দীপক বোসের নেতৃত্বে অন্যান্যদের সাথে খ্রীষ্টযাগের গান পরিবেশন করে। বাংলাদেশে তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোন সরকারী বা বেসরকারী টেলিভিশন ছিল না। ছিল না আজকের মত কোন ক্যাবল টিভি। সরকারী টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনেরও কোন ভ্রাম্যমান ক্যামেরা ক্রু ছিল না, তাদেরকে সংবাদ চিত্রের জন্যে নির্ভর করতে হ’ত সরকারী প্রেস এন্ড পাবিলিকেশনের ১৬ মিঃমিঃ ক্যামেরায় ধারণকৃত ফিল্মের উপর। ব্যক্তি মালিকাধীন ভিডিও ক্যামেরা কারো কাছে ছিল না , পাওয়া যেত না আজকের মত অর্থের বিনিময়ে পেশাধারী কোন ভিডিওগ্রাফার। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদে পরিবেশনার জন্যে সেদিনের সে  অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিত্রধারণের জন্যে সরকারী প্রেস এন্ড পাবিলিকেশনের একজন ক্যামেরাম্যান ১৬ মিঃমিঃ ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ক্যামেরাম্যান যখন চিত্র ধারণ করছিলেন তখনই সর্বসুহৃদ জর্জ ডিঃ রোজারিও,  হিউবার্ট অরূণ রোজারিও, পাস্কেল গমেজ, ক্লির্ফোড চন্দন গমেজ,  সুভাষ সেলেষ্টিন রোজারিও,মাইকেল বকুল গমেজ,পিয়ুস দিলীপ কস্তা,  ডঃ ডনাল্ড গমেজ ও বর্তমান লেখক সুহৃদ ডাঃ নেভেল ডিঃ রোজারিও তড়িৎ সিদ্ধাস্ত নেয় অসুষ্ঠানের উপরে একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের। সিদ্ধাšতানুযায়ী এক ফাকে ক্যামেরাম্যানকে একটু বেশী করে অনুষ্ঠানের চিত্রধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়। ক্যামেরাম্যান ৩ মিনিটের আন্দাজের চিত্রধারণের জন্যে বরাদ্দকৃত ১৬ মিঃ মিঃ ফিল্মের সীমাবদ্ধকার কথা জানালে অতিরিক্ত ফিল্মের ব্যয়ভার সুহৃদ সংঘ বহন করবে বলে জানানো হলে উনি ১০ মিনিটের আন্দাজের চিত্রধারণে রাজী হ’ন। আলোচনায় স্থির করা হয় যে উনি সন্ধ্যার মধ্যে ধারণকৃত ফিল্মের অংশ এডিট করে সূচনা টেল্পের লিখা  ফিল্মটি আমাদেরকে হস্তান্তর করবেন-- বিনিময়ে ফিল্মসহ সর্বসাকুল্যের ব্যয় বাবদ তাকে দে’য়া হবে ৫০০/= টাকা। সর্বসুহৃদ জর্জ ডিঃ রোজারিও ও পাস্কেল গমেজের তত্ত্বাবধানে ক্যামেরাম্যান পুরো অনুষ্ঠানের গুরূত্বপূর্ণ অংশের চিত্রধারণ করেন এবং তাঁরাই সন্ধায় কাকরাইলস্থ নির্দিষ্ট স্থান থেকে তা গ্রহণ করেন। এ ভাবেই নির্মিত হ’ল  একটি সুহৃদ প্রযোজনা হিসেবে আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর উপরে নির্মিত একমাত্র প্রামাণ্য চিত্র ”অন্তিম শয়নে আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী ”। ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন: https://www.youtube.com/watch?v=1JigkBSoIs0

নির্মাণের পর থেকেই সুহৃদ সংঘ যখনই যেখানেই সুযোগ পেয়েছে ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে লক্ষীবাজার, রমনা ও তেজগাঁও গীর্জায়  বিভিন্ন জনসমাবেশে ১৬ মি:মি: প্রজেক্টরের ব্যবস্থা করে। নিজেদের এবং খ্রীষ্টান ছাত্রকল্যাণ সংঘের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও প্রামাণ্য চিত্রটি প্রদর্শিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর। নির্মাণের পর থেকেই যথাযথ সংরক্ষণের জন্যে সুহৃদ সংঘ বার বার যোগাযোগ করেছিল খ্রীষ্টান যোগাযোগ কেন্দ্র  ’বাণীদীপ্তি’ র সাথে --- কোন প্রকার শর্তবিহীনভাবে প্রামাণ্য চিত্রটি হস্তান্তরের জন্যে। ’বাণীদীপ্তি’ কতৃপক্ষ্যের  এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ না দেখানোতে এ হস্তান্তর  করা আর হয়ে উঠেনি। ’বাণীদীপ্তি’র নিজস্ব কোন প্রযোজনা না হওয়ার কারণেই সম্ভবতঃ তাদের এ অনাগ্রহতা ছিল। সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল রমনায়, যেখানে প্রজেক্টরটি পুড়ে যায়। ১৬ মি:মি: প্রজেক্টরের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এবং অযত্ম-অবহেলায় হারিয়ে যায় আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর উপরে নির্মিত একমাত্র   প্রামাণ্য চিত্রটি। এটির অভাব আরও বেশী করে অনুভূত হয়েছিল গাঙ্গুলীর ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে, আর্চবিশপ গাঙ্গুলীকে ধন্যশ্রেণী ভুক্ত করে  ’ঈশ্বরের সেবক’ হিসেবে ঘোষণা  করার  অনুষ্ঠানে  প্রদর্শিত হওয়া,  আর্চবিশপ গাঙ্গুলীকে নিয়ে তৈরী করা শব্দ বিঘ্ন স্থির চিত্রের স্লাইড শোর পরিবেশনাটা দেখে।



সবশেষে অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই প্রিয় আর্চবিশপকে । সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, সুখের বিষয় ২০০৮ সালে বাড়ী বদলের সময় সুহৃদ সংঘের এক প্রাক্তন সভাপতির পুরোনো কাগজের স্তুপের মাঝের পরিত্যক্ত ব্রিফ কেস থেকে উদ্ধার হলো হারিয়ে যাওয়া প্রামান্য চিত্রটি। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে ততদিনে ১৬ মি:মি: প্রজেক্টর স্থান নিয়েছে যাদুঘরে। প্রামান্য চিত্রটি প্রদর্শনের সমস্যায় ঢাকা শহর চষে বেড়ালাম ১৬ মি:মি: থেকে সিডি তে রুপান্তরের সন্ধানে। অবশেষে AVICOM এর সন্ধান পেয়ে এটাকে DVD-CD  করে বিদেশে পাড়ি জমালাম। ২০১২ সনে দেশে গিয়ে এটাতে Title Design and Music সংযোগ করলাম। আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও সিএসসি’র মেরীল্যান্ড সফরকালে তাঁর নিকটএকখানা CD হস্তান্তর করা হয়। ২০১৫ তে https://web.facebook.com/TAGanguly ও আমার FaceBook এ postকরা হয়। 


 ডা: নেভেল ডি: রোজারিও: সুহৃদ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও প্রাক্তন সভাপতি,
 এবং বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন মহাসচিব




No comments:

Post a Comment